বাংলার ৯৫০ সালে নদীয়ার হোগলবেড়িয়া গ্রামের নস্করী দুর্গামাতা স্থাপিত হয়। এই পুজোর সঙ্গে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। ৪৭৬ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে। এখানে প্রতিমা হয় একচালার। এলাকায় এখন নীলকুঠির চিহ্নমাত্র নেই, তবে কুঠির বিলে বিসর্জন হয় আজও। এখন বিলের বদলে সামান্য জলাশয় রয়েছে, জঙ্গলও আর নেই৷ তবে সেজন্য প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রথা কিন্তু পাল্টায়নি এতটুকুও৷ রাস্তাঘাট যতই ভালো হোক না কেন, আজও প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় বাঁশবাগানের পাশের খানা-খন্দ ভরা কাঁচা রাস্তা দিয়েই। বাঁশগাছ আর ঝোপঝাড়ের ডালপালা সরাতে সরাতে প্রতিমা নিয়ে এগোন স্থানীয় চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারগুলির বর্তমান প্রজন্মের কর্তারা৷ শোভাযাত্রায় হাঁটতে দেখা যায় ভিন-সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদেরও। কথিত আছে, ভাসানের পথ বদল করলে প্রতিমা বহন করাই নাকি অসম্ভব হয়ে যায়! একবার অন্য পথ ধরে মূর্তি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল৷ কিন্তু হঠাৎ মূর্তি এতটাই ভারি হয়ে গেল যে প্রায় ৮০ জন মানুষ মিলেও সেই মূর্তি তুলতে পারলেন না৷ ফলে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আবার সেই পুরোনো পথে ৮ জন মানুষ মিলেই প্রতিমা নিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেই থেকে নিরঞ্জনের শোভাযাত্রার পথ আর পরিবর্তন করা হয়নি৷ নস্করীতলার এই পুজোমণ্ডপ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়া জেলার সীমান্ত৷ রাজশাহী জেলা তার পাশেই, দেশভাগের আগে এই কুষ্ঠিয়া নদীয়ার মধ্যেই ছিল৷ জানা যায়, রাজশাহীতেও ‘নস্করীদুর্গা’ নামেই পরিচিত এই দুর্গা। রাজশাহীর এক জমিদারের হাতে এই পুজোর জন্ম৷ স্থানীয় সাধক নস্কর বর্মণকে দিয়ে তিনি প্রথম পুজো করান এই এলাকায়। তারপর থেকে তিনি পুজো করলেও অর্থ ও অন্যান্য রসদ আসত বাংলাদেশের সেই জমিদারবাড়ি থেকে৷ একসময়ে তিনি সেই পুজোর দায়িত্ব প্রসন্ন রায়ের হাতে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বর্তমানে যে চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার এই পুজোকে ধরে রেখেছে, তাঁরা নানা সম্পর্কে সেই প্রসন্ন রায়ের উত্তরসূরী৷ তাঁদেরই একজন, গৌরসুন্দর চট্টোপাধ্যায় শোনালেন এই পুজোর প্রথম প্রচলনের কাহিনি : পালবাড়ি থেকে প্রতিমা ও পুজোর অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে নৌকায় রাজশাহী ফেরার পথে জমিদার মহাষষ্ঠীর দিনে প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন৷ বাধ্য হয়ে রাত কাটানোর সময়ে এখানেই হোগলবেড়িয়াতে তিনি পুজো করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন৷ সেই আদেশ শুনে পরদিন তিনি কালীসাধক নস্কর বর্মণকে অনেক পীড়াপীড়ি করে পুজো করাতে সম্মত করেন৷ তবে নস্কর সাধু উধাও হয়ে যাওয়ার পর, জমিদার বাড়ি থেকে পাঠানো অর্থসাহায্য ক্রমশ কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেলেও প্রসন্ন রায়ের পরবর্তী প্রজন্ম সেই পুজোকে এখনও ধরে রেখেছে৷